এক নারীর সব হারানোর গল্প- দুঃখবাড়ি
সকাল থেকে সাবেরা বেগমের শাশুড়ি ছেলের
জন্য কান্নাকাটি করছেন। মাঝে মাঝেই তিনি ছেলের জন্য কাঁদেন। তবে আজকে একটু
বেশিই হা হুতাশ আর কান্নাকাটি করছেন। সাবেরা বেগমের মনটাও কেমন যেন অস্থির
হয়ে আছে। উঠোনের সামনে নারিকেল গাছটার মাথায় বসে দু’তিনটা কাক একইভাবে ডেকে
চলেছে। সেগুলোই তাড়ানোর চেষ্টা করছেন তিনি। ‘হুস হুস যা, ওই মরার কাক,
ডাকার আর জাগা পাচ্ছিসনে যা একেনতে যা, হুস হুস। কিডা মইরেছে তোগের? যা
ভাগ, হুস হুস।’ এক সময় কাক তাড়ানো বন্ধ করে ঘরের বারান্দায় এসে বসেন সাবেরা
বেগম। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মোছেন। কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে তার শাশুড়ি বের হয়ে
আসেন। ‘ও বউ মা, কি হইছে, কি তাড়াও?’ জবাব দেয় সাবেরা বেগম,‘সকালতে
কাকগুলো ডেকেই যাচ্ছে আম্মা, কি বিপদ যে ডেইকে আনচে জানে কিডা।’ উপর দিকে
তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ছাড়েন সাবেরা বেগমের শাশুড়ি। তারপর সাবেরা বেগমের দিকে
তাকিয়ে বলেন,‘ও বউ মা, আমার কিরাম জানি খুব অস্থির লাগচে, ছেলেডার জন্যি
কিরাম জানি লাগচে। মনে হচ্চে ওর কি যেন হয়েচে। বেশ কদিন হলো চিটিপত্তর তো
দেয়না।’ সাবেরা বেগম শান্তনা দেন তার শাশুড়িকে। ‘আপনি কোনো চিন্তা কইরেন না
মা। সুমায় পাচ্চে না হয়তো। সুমায় পালি দেবেনে চিটি।’
বউ শাশুড়ি
ঘরের বারান্দায় বসে থাকেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। হটাৎ সাবেরা বেগম
কোথায় যেন হারিয়ে যান। সে মনে করতে থাকে শেষ কবে চিঠি দিয়েছিল তার স্বামী।
আর কি কি লেখা ছিল সে চিঠিতে। চিঠি কবে দিয়েছিল সেই তারিখ মনে করতে পারে না
সে। কিন্তু চিঠিতে লেখা প্রতিটা লাইন মুখস্ত সাবেরা বেগমের। সাবেরা বেগমের
মনে পড়ে, তার স্বামী শীতের শেষে বাড়ি আসার কথা বলেছিল চিঠিতে। একটা চিঠির
কথা মনে হতেই আনমনে হেসে ওঠে সাবেরা বেগম। তখনও ছেলেমেয়ে হয়নি সাবেরা
বেগমের। অথচ তার স্বামী ছেলে মেয়েদের নাম ঠিক করে পাঠায়। লজ্জায় যেন শেষ
হয়ে যায় সে।
হটাতই গাড়ির হর্ণে চিন্তাই ছেদ পড়ে সাবেরা বেগমের। বউ
শাশুড়ি দুজনই লক্ষ করেন বাড়ির সামনে থেকেই গাড়ির থেকে হর্ণ বাজছে। বুকের
মধ্যে কেমন যেন ধাক্কা খান সাবেরা বেগম। সাবেরা বেগমের শাশুড়ি বলেন, ‘ও
বউমা কি হইলো, আমার ছেলের কিছু হইছে নাকি?’ বলেই দৌড়ে যান গাড়ির দিকে।
সাবেরা বেগমও শাশুড়ির পিছন পিছন যান। গিয়ে দেখতে পান এ্যাম্বুলেন্স, সাথে
পুলিশ এবং আরও লোকজনসহ তিন চারটা গাড়ি দাঁড়ানো। একজন পুলিশ অফিসার এগিয়ে
আসেন। তারপর সাবেরা বেগমের পরিচয় জানতে চান, তারপর বলেন, ‘চলেন বাড়ির ভেতরে
গিয়ে কথা বলি।’ বউ এবং শ্বাশুড়ি দুজনারই ভেতরে অস্থিরতা চলতে থাকে। তারপর
সাবেরা বেগম এবং ওনার শাশুড়িসহ বাড়ির ভেতরে যান। এরপর পুলিশ অফিসার যে
সংবাদটা শোনালেন। সেটা শোনার জন্য বউ শ্বাশুড়ি কেউ প্রস্তুত ছিলেন না।
খবরটা শোনার পর বউ শাশুড়ি দুজনে উঠোনেই মাতম করতে থাকে। কান্নার শব্দ শুনে
আশে পাশের বাড়ি থেকে প্রতিবেশীরা আসতে শুরু করেন। তারাও শোনেন সংবাদটা।
শান্তনা দেন ওনাদের। যে সংবাদটা শুনে এই বাড়িতে হটাৎ শোকের মাতম শুরু হয়েছে
তা হলো, গতকাল রাতে সাবেরা বেগমের স্বামী সেকান্দার আলী একটা সড়ক
দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। সরকারি চাকরি করতেন সাবেরা বেগমের স্বামী।
সাবেরা
বেগমের তিন ছেলে এক মেয়ে। চারটা ছেলে মেয়ে নিয়ে যেন অথৈ সাগরে পড়েন সাবেরা
বেগম। তার জীবনে এরকম কালবৈশাখী ঝড় আসবে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি তিনি।
বড় ছেলে মিজানুর রহমান এবার ক্লাশ নাইনে পড়ে। মেজো ছেলে মিলন সেভেনে। ছোট
ছেলে মানিক ফাইভে আর একমাত্র মেয়ে শাহিদা পড়ে ক্লাশ এইটে।
সেকান্দার
আলী মারা গেছেন প্রায় একবছর। এর মধ্যে সাবেরা বেগমও শোক সামলিয়ে উঠেছেন।
সরকার থেকে তার স্বামীর পেনশন আর মাঠের জমি থেকে বছরে কিছু ধান আসতো,
মোটামুটি ভালই চলছিল। কিন্তু বিপদ যেন সাবেরা বেগমের পিছু ছাড়েনা। মাঠে
তিনবিঘা ধানি জমি ছিল তার স্বামীর নামে। আর বাড়ির সামনে এক বিঘা পতিত জমি,
আম কাঁঠাল আর কিছু মেহগনি গাছ লাগানো ছিল সেই জমিতে। সেই জমিগুলো হটাৎ তার
দেবর আর ভাসুরেরা তাদের বলে দাবি করতে থাকে। তারা কিভাবে কিভাবে যেন কাগজ
পত্রও তৈরি করে ফেলে তাদের নামে। তার শাশুড়িও বলে যে ওই জমি তাদেরই। সুতরাং
জমিগুলোও হাতছাড়া হয়ে যায়।
তবুও সরকারি টাকাগুলো পাওয়ায় রক্ষা।
ওটা দিয়েই কষ্টে সৃষ্টে চলছেন তিনি। ক্লাশ নাইনে ওঠার পরপরই একমাত্র মেয়েকে
ভাল ঘর দেখে বিয়ে দিয়ে দিলেন সাবেরা বেগম। বিয়ের ছ’ মাস না যেতেই শ্বশুর
বাড়ির লোকজন যৌতুক দাবি করে বসলো। নানারকম কথা শোনাতো। মেয়ে মুখ বুজে থাকতো
কাউকে কিছু বলতো না। তার শাশুড়ি মাঝে মাঝে খেতেও দিতো না। ছোটো মেয়ে একদিন
বিষ খেয়ে বসলো। আর বাঁচানো গেল না তাকে। সাবেরা বেগমের শোক বইতে আর একটা
শোক যুক্ত হলো।
রাজপুত্রের মত তিন ছেলে সাবেরা বেগমের। ছেলেদের
মুখের দিকে তাকিয়ে স্বামী আর একমাত্র মেয়ে হারানোর ব্যাথা ভুলে থাকার
চেষ্টা করেন সাবেরা বেগম। সবসময় আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, আল্লাহ যেন তার
মানিকদের বাঁচিয়ে রাখেন। ভাল রাখেন। সুস্থ সুন্দর রাখেন। এর মধ্যে কেটে যায়
বেশ ক’বছর। বড় আর মেজো ছেলেটা আইএ পাশ করে আর পড়াশোনা করেনি। দু’ভাই বাড়ির
পাশে বাজারে একটা মুদি দোকান দিয়েছে। ভালই চলছে তাতে। আর ছোটোটা এবার বিএ
ভর্তি হলো।
সাবেরা বেগম শোক বইটা বন্ধ করে রাখেন। ওটা খুলতে চাননা
কোনো সময়। ওটা খুললেই রাজ্যের কষ্ট এসে তাকে চেপে ধরে। তার থেকে ভাল তিনি
একটা সুখী সংসারের স্বপ্ন দেখেন। বড় ছেলেকে বিয়ে দিবেন। সুন্দর ফুটফুটে
একটা বউ আসবে বাড়িতে। বাচ্চা কাচ্চা হবে। পুতি-পুতনীদের সাথে তিনি গল্প
করবেন। হাসি তামাসা করবেন। এভাবেই তার বাকি জীবনটা কেটে যাবে। ভাবছেন বড় আর
মেজো ছেলেটাকে একসাথেই বিয়ে দিবেন। মনে মনে মেয়েও খুঁজতে থাকেন বিভিন্ন
দিকে।
কিন্তু অনেক সময় মানুষ যা ভাবে তার কিছুই হয়না। নিয়তিও বোঝে
সে কথা। হয়তো সে কারণেই নিয়তি বার বার সাবেরা বেগমকে নিয়ে নিষ্ঠুর নিদারুণ
পরিহাস করে। হটাৎ করেই বাড়িতে খবর আসে, সাবেরা বেগমের ছোটো ছেলেটা
হাসপাতালে, অবস্থা খুবই খারাপ। রাস্তার পাশে ফসলের খেতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল।
কারা যেন হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সাবেরা বেগম তার দুই ছেলেকে নিয়ে ছুটলেন
হাসপাতালে। গিয়ে দেখলেন তার ছেলের প্রাণহীন দেহটা পড়ে আছে হাসপাতালের
বারান্দায়। ছেলের পাশে বসে চিৎকার করে হাসছেন সাবেরা বেগম। আর বলছেন ‘দেকো,
দেকো সবাই, আমার মানিক কিরাম কইরে ঘুমোচ্চে দেকো।’ হাসপাতালের মানুষজন
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন ছেলের মৃতদেহ দেখে হাসতে থাকা মায়ের দিকে। হাসতে
হাসতে চুপ হয়ে যান সাবেরা বেগম। নিথর ভাবে বসে থাকেন ছেলের মাথার কাছে।
‘আমার মানিক, আমার মানিক’ দুতিন বার বিড়বিড় করে বলেই অজ্ঞান হয়ে যান তিনি।
সাবেরা বেগমের শোকবইতে আরও একটা শোক লেখা হয়।
বেশ কজনের কাছ থেকে
টাকা ধার নিয়ে একটা এনজিও ব্যবসায় বেশি মুনাফা লাভের আশায় টাকা খাটায়
মানিক। কিছু লাভও পায়। তারপর হটাৎ করেই এনজিওর অফিসে তালা মেরে সেখানকার
লোকজন সব উধাও। ওর টাকাও মাইর যায়। পাওনাদাররা কথা শোনাতো, মামলা করারও
হুমকি দিতো। শেষ পর্যন্ত আর কোনো পথ না পেয়ে আত্মহত্যার মত পথ খুঁজে নেয়
সে।
এভাবে একদিন দুদিন করে প্রায় তিন বছর পার হয়। সাবেরা বেগমের
দু’ছেলে মায়ের কাছেই থাকে। ব্যবসা দেখাশোনা করে। আর বাড়িতেই থাকে। বাড়িতে
একটা বউ দরকার সেজন্য বড় ছেলের জন্য মেয়ে দেখা হয়। কিন্তু বেঁকে বসে সে।
বাড়ি ঘর ঠিক না করে বিয়ে করবে না। বায়না ধরে বিদেশ যাবার। রাজি হন না
সাবেরা বেগম। কিন্তু ছেলের জেদের কাছে হার মানতে হয় তাকে। অবশেষে সৌদি
প্রবাসী হয় তার বড় ছেলে মিজানুর রহমান।
মিজানুর সৌদী প্রবাসী হয়েছে
প্রায় চার বছর। এর মধ্যে হজ্জও করেছে সে। মায়ের সাথে নিয়মিত কথা হয়। মাকে
বলেছে মেয়ে দেখার জন। গ্রামের ভিটায় নতুন বাড়ি তৈরিও শেষ। এবার বিয়ে করা
যায়। বিয়ে করবে বলে বউয়ের জন্য বেশ কয়েক ভরি গহনাও কেনে সে। মায়ের জন্য
স্বর্ণের চেইন কেনে। আত্মীয় স্বজনদের জন্য জায়নামাজ তসবীহ এসব কেনে। সামনের
মাসেই বাড়ি আসবে ছয় মাসের ছুটিতে। আর পনের ষোলো দিন পরেই। মেয়েও একরকম
দেখা ঠিকঠাক।
সাবেরা বেগম অপেক্ষা করেন ছেলের জন্য। ছেলের পছন্দের
খাবারগুলি তৈরি করে রাখেন। কতদিন পর তার ছেলে বাড়ি আসবে। কতবছর হয়ে গেল
ছেলের মুখ দেখেননি তিনি। মনে মনে ভাবেন সাবেরা বেগম, ছেলে আসলে তিনি ছেলেকে
আর বিদেশ যেতে দেবেন না। বলবেন, বাড়িতে থেকেই কিছু করতে। ছেলেকে সবসময়
চোখের সামনে রাখতে চান তিনি। তাছাড়া বিয়ে করে বউ বাড়িতে রেখে বিদেশ
যাওয়াটাকেও ভাল চোখে দেখেন না তিনি। আর মানুষেও নানান কথা বলে। কিন্তু
নিয়তি যেন আবারও নিঠুর পরিহাসের হাসি হাসলো সাবেরা বেগমকে দেখে। সৌদী থেকে
ফোন আসে মিজানকে ছুরি মারা হয়েছে, সে এখন আশঙ্কজনক অবস্থায় হাসপাতালে
ভর্তি। সাবেরা বেগমের মনের মধ্যে কি চলছিল খবরটা শোনার পর সেটা আল্লাহ
জানেন। মানুষের পক্ষে সেটা জানা হয়তো সম্ভব না। বাড়িতে আবারও মাতম উঠলো।
সাবেরা বেগমের কেবলই মনে হচ্ছিল হয়তো তার ছেলে বেঁচে নেই।
উদ্বেগ
আর উৎকণ্ঠায় পার হচ্ছিল সবার এক একেকটা মুহুর্ত। এক ঘণ্টা পর আবারও ফোন
আসলো। ওখান থেকে জানানো হলো মিজান আর বেঁচে নেই। আলেয়া বেগমের শোক বইতে আরও
একটা শোকমালা লেখা হলো।
যখন কোনো মায়ের স্বামীসহ একে একে আদরের
তিনটি সন্তান মারা যায়, তখন সেই মায়ের কি হয়? কেমন হয় তার সেই শোকটা? সেটা
জানা বা তার বর্ণনা দেয়া কোনো মানুষের পক্ষে সত্যিই সম্ভব না। সেটা আল্লাহ
ভাল জানেন আর জানেন সেই মা।
মিজান সৌদিতে যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতো
সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক খুবই ভদ্রলোক ছিলেন। মিজানের উপর তিনি বরাবরই খুব
খুশি ছিলেন। সেজন্য তার প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব সবটাই মিজানের উপরে দিয়ে
দিয়েছিলেন। কিন্তু এই বিষয়টাই মেনে নিতে পারেনি ওই প্রতিষ্ঠানে আগে থেকে
চাকরি করা বাঙালি ক’জন প্রবাসী। তারা চারপাঁচজন একত্রিত হয়ে ছুরিকাঘাত করে
খুন করে মিজানকে। এরপর ওখান থেকে আর লাশ আনা হয়না বাংলাদেশে। সৌদি আরবের
পবিত্র ভূমিতেই সমাধিস্থ করা হয় মিজানকে।
একদিন একদিন করে আবারও বেশ
ক’বছর কেটে যায়। মেজো ছেলেকে বিয়ে দেয়া হয়। স্বাভাবিক ভাবে এটা তো আশা
করাই যায় এমন শোকের পরে বেঁচে থাকা একমাত্র ছেলের মাথার মনি হয়েই থাকবেন
সেই মা। কিন্তু নিয়তি যেন সাবেরা বেগমের জন্য সুখ লিখে রাখেনি। তাইতো
একমাত্র ছেলেটাও মাকে ছেড়ে বউ নিয়ে আলাদা বাসা ভাড়া করে থাকে। ছেলের বউয়ের
সাথে বনিবনা হয়না সাবেরা বেগমের। ছেলেটাও দোষ দেয় মায়েরই। ঘটনা যাই হোক
সাবেরা বেগম সবকিছু নিয়তির উপরই ছেড়ে দিয়েছেন।
এই দুঃখবাড়িতে সাবেরা
বেগম একা থাকেন। একেবারেই একা। এই দুঃখবাড়ির একমাত্র বাসিন্দা তিনি। আমরা
কখনোই জানতে পারবো না, এই দুঃখবাড়িতে সাবেরা বেগমের প্রতিটা মুহুর্ত কিভাবে
কাটে। শুধু আন্দাজ করে নিতে পারি হয়তো। কিন্তু সেই আন্দাজটাও যৎসামান্যই।
কোন মন্তব্য নেই