এক চিলতে আকাশ
মেয়েটিকে নিয়ে রেলষ্টেশন থেকে বের হলো মিঠুন। শহরের নিয়ন বাতির আলোয় হারিয়ে যাওয়া চাঁদটা মেঘের ভেতর থেকে সম্পুর্ন বেরিয়ে এসেছে। চাঁদের আলোয় চারিদিক কেমন ঝকঝক করছে। মনটা অদ্ভুদ ভাল লাগায় ভরে গেল ওর। ওর ইচ্ছে হলো মেয়েটিকে নিয়ে কিছুক্ষণ রেললাইনের উপর বসে গল্প করার।
কোনো মেয়ের জোছনা ভাল লাগে না এই কথাটা সে প্রথমবারের মত নিজ কানে শুনলো এবং তাও আবার স্বয়ং একটি মেয়ের মুখ থেকে। চাঁদ, জোছনা, বৃষ্টি এগুলো তো প্রাকৃতিক ভাবে মেয়েদেরই ভাল লাগার জিনিস। এতদিন সেটাই জানতো মিঠুন।
-আপনার চাঁদ ভাল লাগে না বিষয়টা আমার কাছ সত্যি খুব অবাক লাগছে।
-অবাক হবার কিছু নেই আমার মত বিপদে পড়লে আপনারও শুধু চাঁদ কেন আরও ভাল কিছু থাকলেও ভাল লাগতো না।
-আচ্ছ^া ঠিক আছে, তা কি করতে চান এখন?
-আমি তো এখন ফিরে যেতে পারবো না, কারণ আমার বোনের বাসা অনেক ভিতরে সেখান থেকে গাড়ি পাওয়া যাবে না, আপনি আমার জন্য আজ রাতে কোথাও থাকার ব্যবস্থা করেন।
-হুম বুঝতে পারছি, ও আপনার নামটাই তো জানা হলো না, আপনার নাম কি?
-চাঁদনী, আপনার?
-মিঠুন
-আপনার নাম চাঁদনী অথচ আপনার চাঁদ ভাল লাগে না, সত্যিই অবাক হবার মত বিষয়। ও আচ্ছা, ঠিক আছে দেখি আপনার জন্য কি করা যায়।
অবশেষে বিভিন্ন চিন্তা ভাবনা করে ওর বন্ধু সাইমাকে ফোন দিল মিঠুন, কারণ মিঠুন জানে একমাত্র সাইমাই পারে ওকে হেল্প করতে। সাইমাসহ চারজন মেয়ে একটা ফ্লাটে থাকে। ওকে বললে ওর কাছে হয়তো একটা রাত রাখতে পারবে ওকে।
কিন্তু অনেক সময় মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক।
-কি ব্যাপার কোন ব্যবস্থা হল?
-একমাত্র যে ভরষা ছিল সেটাও শেষ হয়ে গেল। গ্রাম থেকে ওর এক বান্ধবীর মা আর বোন এসছে ওদেরই হাঁপানি লাগা অবস্থা নাকি।
-আপনার বাসায়...
-আমার বাসায় নিয়ে গেলে আপনাকেসহ আমাকে আজীবনের জন্য তাড়াবে
-ওহ, তাহলে কি করবো, কেন যে ট্রেনে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম !!
-এককাজ করি চলেন এয়ারপোর্ট রেলওয়ে ষ্টেশনে যায় ওখানকার ষ্টেশনটা নিরাপদ। সারারাত ষ্টেশনে গল্প করে কাটিয়ে দেই একটা রাতই তো।
-ঠিক আছে চলেন, তাছাড়া তো বিকল্প আর কোনো পথও খোলা নেই।
উত্তরা এয়ারপোর্ট রেলষ্টেশনে একটি বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে মিঠুন আর চাঁদনী। রাত গভীর হচ্ছে। একটা একটা করে ট্রেন আসছে। কিছুক্ষণ দাড়াচ্ছে। যাত্রী নামছে আবার উঠছে, ট্রেন চলে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাবার পরে কথা বলে উঠলো চাঁদনী।
-আচ্ছা আপনার ক্ষুধা লাগেনি? আমার কিন্তু ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে।
-বেকার মানুষদের ক্ষুধা লাগে না, এই একটা সুবিধা জানেন। বেকার মানুষদের ক্ষুধা কম।
রেষ্টুরেন্ট থেকে খাওয়া দাওয়া শেষ করে আবার আগের জায়গাটিতে বসলো ওরা। রাত বাড়ে, রাতের সাথে আস্তে আস্তে বাড়ে কথা। সে কথা বাড়তেই থাকে বাড়তেই থাকে। কথা বাড়তে বাড়তে একসময় শেষ হয়। এরপর রাতও ফুরায়, আসে নতুন ছন্দে নতুন একটা ভোর ।
এতভোরে চাঁদনীর ঘুম ভাঙে না কিন্তু আজকে কেন যেন ঘুম ভেঙে গেল। চারপাশে মানুষের কোলাহল গাড়ির হর্ণ, ও ঠিক বুঝতে পারছে না কোথায় আছে, চোখ মেলে তাকাতেই একটা অপরিচিত ছেলের চোখে চোখ পড়লো। কয়েক সেকেন্ড পর আবিষ্কার করলো ওই ছেলেটির কোলে মাথা রেখেই ও শুয়ে আছে। খুবই অবাক হলো চাঁদনী। তাড়াতাড়ি উঠে বসলো কোথায় আছে বোঝার চেষ্টা করলো। আস্তে আস্তে সবকিছুই মনে পড়লো ওর। ভীষণ লজ্জা পেল সে। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না।
-আচ্ছা আমার ব্যাগটা কোথায়?
-ব্যাগ আপনার পায়ের কাছেই আছে, ভাল করে তাকান দেখতে পারবেন।
-ওহ, আচ্ছা এরপর ট্রেন কখন আসবে বলতে পারবেন?
-সাড়ে ছয়টায় একটা ট্রেন আসার কথা, আর বেশিক্ষণ নেই, টিকিট কেটে রাখুন, ট্রেন আসলে উঠে পড়বেন।
চাঁদনী উঠলো, টিকিট কাটতে যাবার উদ্দেশ্যে, যাবার সময় কি এক বিষন্ন দৃষ্টিতে মিঠুনের দিকে তাকালো সে, মিঠুন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শুধু।
যথাসময়ে ট্রেন আসলো, মিঠুন চাঁদনীর সিট খুঁজে দিতে ট্রেনে উঠলো। নির্ধারিত সিটে চাঁদনীকে বসিয়ে দিল। পাশের সিটটা ফাঁকাই ছিল তাই ওই সিটে কিছুক্ষণ বসলো মিঠুন। চুপচাপ বসে আছে মিঠুন। ট্রেনের হর্ণ বেজে উঠলো চাকা গুলোও আস্তে আস্তে ঘুরতে শুরু করলো। কথা বললো মিঠুন।
-ঠিক আছে আপনি তাহলে যান, ভাল থাকবেন।
-ঠিক আছে আপনিও ভাল থাকবেন, নিজের প্রতি খেয়াল রাখবেন।
মিঠুনের চোখের কোনে পানি, সে পানি কিসের জন্য জানে না মিঠুন। তবে কি চাঁদনীর চোখেও পানি ছিল। ঝাপসা চোখে সেটা দেখতে পায়নি সে। ট্রেন থেকে নেমে একদৃষ্টিতে চাঁদনীর দিকে চেয়ে থাকলো মিঠুন। চাঁদনীও খোলা জানালা দিয়ে মিঠুনের দিকে চেয়ে থাকলো। একসময় ট্রেনটা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। মিঠুনের বুকটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠলো। ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো ও, আকাশটাও কি শুন্য আজ। না আকাশের বুকে সাদা সাদা মেঘ জমে আছে, সেসব মেঘেরা যেন দল বেঁধে কোথাও যাচ্ছে। শুধু মিঠুনের বুকটাতে আজ শুধুই শুন্যতা ভর করেছে। এই শুন্যতা কিসের মিঠুন নিজেও জানে না।
কোন মন্তব্য নেই