Header Ads

Header ADS

বিবর্ণ প্রজাপতি



রাজু আহমেদ : রাজধানীর একটি ব্যস্ততম এলাকা মগবাজার। শহরের অন্যান্য এলাকার মত এখানেও দিনে-রাতে মানুষের নিত্য আসা যাওয়া। ফ্লাই ওভার তৈরি হবার কারণে জ্যাম লেগে থাকে প্রায় প্রতিদিনই। আজকেও তার ব্যতিক্রম না বরং অন্যদিনের থেকে আজকে একটু বেশিই জ্যাম। জ্যাম বেশি থাকলে অবশ্য নুপুরের জন্য ভাল হয় ওকে এক গাড়িতে চড়ে অনেকদুর যেতে হয়না। দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি গুলোতেই সে একের পর এক উঠতে পারে। এতে তাঁর ব্যবসাটা ভাল জমে। যদিও আজকাল মানুষগুলো সব যেন কেমন হয়ে গেছে কেউ আর এসব বিশ্বাস করতে চাইনা। তবু বেঁচে থাকার প্রয়োজনে নুপুরকে প্রতিদিন এসব মানুষগুলোর কাছেই আসতে হয়। এছাড়া আর করবেই বা কি সে।
নুপুর বাসে বাসে লজেন্স বিক্রি করে। বয়স কতই বা হবে বার কি তের। এই বয়সে সে রোজগার করে, রোজগার একেবারে খারাপ হয়না। নুপুর ছয় নম্বর বাসে উঠল যে বাসটি মগবাজার, ফার্মগেট হয়ে গুলশান যায়। বাসে ভিড় নেই ভিড় থাকলে আবার বাসে ওঠা যায়না আর বাসের হেল্পাররাও উঠতে দেয়না। তবে ভিড় থাকলে সে বাসে ওঠেও না।

‘আস্সালামুআলাইকুম, সম্মানীত যাত্রী ভায়েরা আমি আপনাদের ছোট বোনের মত, আমি এতিম ও অসহায় আমার বাবা নাই, বাড়িতে ছোট ছোট দুইটা ভাই বোন মা অসুস্থ কাম করতে পারে না আমি আপনাদের কাছে ভিক্ষা চাইনা, শুধু আমার কাছ থেইকা একটা লজেন্স কিনেন। ভাইজানেরা আমারে একটু সাহায্য করেন। এই বয়সে আমার স্কুলে যাওয়ার কথা অথচ এই বয়সে আমি আপনাদের কাছে লজেন্স বিক্রি করছি। আমারে একটু সাহায্য করেন ভাইজানেরা।’ এরপর সবার হাতে একটা করে লজেন্স ধরিয়ে দেয় নুপুর, আগে একটা কাগজে লেখার টুকরো দিত এখন দেয়না। কেউ পড়েনা। তাই এখন সব মুখেই বলে। এই বাসে দশ টাকার লজেন্স বিক্রি হলো। কোনো কোনো বাসে আবার পাঁচ টাকারও হয়না।
নুপুরের মা যে অসুস্থ এইটা ঠিক না ব্যবসার খাতিরে মায়ের অসুখের কথা বলতে হয় তানা হলে ব্যবসা জমেনা। তারপরও বাসে কত রকমের মানুষ আছে একেক জন একেক রকম কথা বলে। এইতো সেদিন একটা বাসে এক লোক তার হাত চেপে ধরল হাত ধরে বলে ‘আহা তুমি স্কুলে যাওনা খুকি। আর তোমার মাকি সত্যি অসুস্থ, কি হয়েছে ওনার।’ নুপুর কিছু বলতে পারেনা। যদিও সে বোঝে লোকটির হাত ধরার মধ্যে একটা বদ মতলব লুকিয়ে ছিল। সেদিন ঝামটি দিয়ে হাত সরিয়ে নিয়েছিল সে। সুযোগ পেলেই অনেকেই তার গায়ে হাত দেবারও চেস্টা করে। পরিবেশ ওকে বয়সের থেকে একটু বেশিই বুদ্ধিমান করে দিয়েছে। তাই দু’দিন হলো সে বড় একটা ওড়না কিনেছে। এটা দিয়ে সারা গা মাথা ঢেকে রাখে। এখন আর কেউ তার দিকে আগের মত করে তাকায় না। এবং এখন কেন যেন আগের থেকে মানুষ লজেন্স কেনে বেশি। আর আগে মানুষ কেমন করে জানি খালি বুকের দিকে তাকিয়ে থাকতো। কেউ কেউ তো চোখই সরাতো না। লজেন্স কেনার নাম করে অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখতো এটা ওটা জিজ্ঞেস করতো আর চোখ থাকতো বুকের দিকে। কেউ কেউ আবার..থাক সেসব কথা মনে করতে চাইনা সে। এখন সে বেশ ভালই আছে। যা রোজগার তার বেশির ভাগ তার মায়ের হাতে তুলে দেয়। বাকিটা সে নিজের কাছে রাখে। আবার মাঝে মাঝে ছোট বোনটার জন্য এটা সেটা কিনে নিয়ে যায়। ছোট বোনটা কত খুশি হয় ওর খুশি দেখলে খুশিতে ওর নিজেরও বুকটা ভরে যায়।

রেললাইনের উপরে বসে আছে নুপুর। এতো ছোট বয়সেই অনেক কিছু ভাবে সে। খুব শখ ছিল ছোট ভাই বোন গুলারে লেখাপড়া শেখাবে। নুপুরের ছোট বোনটার বয়স ২ বছর আর ছোট ভাইটার বয়স দশ বছর ও টোকাই। নুপুরের খুব স্বপ্ন ছিল ছোট ভাই আর বোনটাকে স্কুলে পড়াবে কিন্তু কিভাবে পড়াবে সে বুঝতে পারে না। ছোট বোনটাকে একটা বইও কিনে দিয়েছে নুপুর। সে নিজে ক্লাশ থ্রী পর্যন্ত পড়েছে। তাই ছোট বোনটাকেও একটু একটু পড়াতে পারে। ছোট বোনটাও কত সুন্দর করে পড়ে সলে অ সলে আ। হটাৎ পুুুউউউউ আর ঝিকঝিক ঝিকঝিক শব্দে ট্রেন চলে আসে। নুপুর উঠে দাঁড়ায় ট্রেনের শব্দে নুপুরের স্বপ্ন গুলোও কোথায় যেন হারিয়ে যায়। আনমোনা নুপুর উদাস হয়ে চলন্ত ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

দেখতে দেখতে নুপুরের বয়স বয়স ১৫ বছর হয়ে গেল। সময়ের সাতে পাল্লা দিয়ে নুপুরের বয়সও যেন কিছুটা বেড়ে চলেছে। নুপুরের মায়ের ট্রেন লাইনে স্লিপ খেয়ে পড়ে গিয়ে আঘাত লাগে । অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। চিকিৎসা করাতে টাকা খরচ হয়। কিন্তু টাকার অভাবে ভালভাবে ঠিক ভাবে চিকিৎসা করাতে পারে না সে। চোখে অন্ধকার দেখে নুপুর। এরই মাঝে একদিন খালা ডাক দেয় নুপুরকে। হাসি খালা ওদের রেল লাইনের বস্তিতেই থাকে। মায়ের এক সাথেই কাজ করতো। তবে ওর কি কারণে যেন ওই মহিলাকে পছন্দ করতো না। কারণটা অবশ্য নুপুর জানে না। শুধু তাই না নুপুরকে তার সাথে কথা বলতেও বারণ করতো। ‘কিরে ছেমরি তোর মায়ের যে এই অবস্থা কিছু করন লাগবোনা? হুন ছেমরি আমি তোরে একখানে নিয়া যামুনে। তুই চিন্তুা করিছ না সাহেব অনেক ভাল মানুষ তোর কামে খুশি হইলে তোরে অনেক ট্যাকা দিব তুই তোর মায়েরে চিকিৎসা করাইতে পারবি।

হাসি খালা যা বললো তা নুপুর কিছুতেই মানতে পারছেনা। এতোদিন ধরে নিজেকে ঢেকে রেখেছে সে, কতভাবে নিজেকে বাঁচিয়েছে আর আজ কিনা। টাকার জন্য নিজের সবকিছুকেই আর একজনের কাছে বিক্রি করে দেবে। হাসি খালাকে বলে নুপুর সে কথা। সে কিছুতেই এই কাজ করতে পারবেনা। এমন পাপ কাজ সে মরে গেলেও করবেনা। হাসি খালাও বোঝায় নুপুরকে। ‘দেখ ছেমরি তুই তো আর নিজের লাইগ্যা এই কাম করতাছোস না তুই করতাছোস তোর মায়ের চিকিৎসার লাইগ্যা। আর তাছাড়া তুইতো আর সব সময় এইডা করবি না। এইডা পাপ নারে ছেমরি। এতে কুনু পাপ নাই। আমরা অভাবি মানুষ । আমরা তো আর ইচ্ছা কইরা এইগুলান করতাছি না। আল্লাহ বুঝবো মাফ কইরা দিবো। আস্তে আস্তে যেন রাজি হয় নুপুর।

পরদিন সন্ধ্যায় হাসি খালার সাথে মগবাজার আদ্দিন হাসপাতালের গলির একটা বাসায় যায়। পাঁচতলা বাসা। লোকটা নাকি ছিনেমার গানটান কিসব করে সেসব হাসি খালা বলেছে ওকে। একাই থাকে। হাসি খালাই নাকি ওনার বাসার কাম কাজ করে। লোকটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল হাসি খালা। বয়স হয়তো পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। ওনাকে ভদ্র লোকই মনে হলো নুপুরের। এমন ভদ্র লোক খারাপ হতে পাওে সে কথা নুপুর ভাবতে পারছে না। অবশ্য মানুষ দেখে তো চেনা যায়না ভদ্র লোকেরাই বেশি খারাপ হয়। কিছুই বললেন না তিনি, শুধু নাম জিজ্ঞেস করলেন। হাসি খালাকে বললেন আমাকে নাস্তা দিতে, হাসি খালা নিজেই আমাকে নাস্তা দিলেন। এরপর হাসি খালাকে ডেকে কি যেন বললেন। হাসি খালা যাবার সময় বললেন তুই থাক আমি ঘণ্টা খানিক পরে আইতাছি। বলেই হাসি খালা চলে গেলেন।

ভদ্র লোক আমাকে এবার তার রুমে নিয়ে গেলেন। একটা তোয়ালে দিলেন, ‘বললেন ওই যে ওয়াশ রুম যাও গোসল করে এসো। বাথ রুমে ঢুকে সব কিছু দেখিয়েও দিলেন। নুপুর বুঝলো বস্তির মাইয়্যা গায়ে নানা রকম গন্ধ থাকে তাই গোসল করে নিতে বলছেন। কিছু না বলে ওয়াশ রুমে গেল নুপুর। বড়লোকদের বাথরুমও এমন সুন্দর হতে পারে সে ভাবেনি আগে। গায়ে সাবান মাখলো মাথায় শ্যাম্পুও করলো নুপুর। আজ যেন অনেক দিন পর নিজেকে খুব হাল্কা মনে হচ্ছে। ফুরফুরে লাগছে বেশ।

লোকটির কোনোকিছুই বুঝতে পারছে না নুপুর। গোসল করে বের হবার পর নিজেই নুপুরের সারা শরীরে কি একটা ছিটিয়ে দিল এত সুন্দর গন্ধ খুব ভাল লাগল নুপুরের কাছে। এরপর বলল, ‘তোমাকে খুব ভাল লেগেছে আমার। হাসি খালা তো তোমাকে সবকিছু বলেছে তাই না। তুমি ভাল থাকবা আমি তোমাকে অনেক টাকা দেব। তোমার কোনো অভাব থাকবে না। শর্ত শুধু একটাই তুমি বাহিরে এগুলো কারও কাছে বলতে পারবা না।’ নুপুর শুধু চুপ করে শুনে গেল। এরপর ঘরের দরজাটা লাগিয়ে দিল।

এতক্ষণ কিছুই মনে হয়নি কিন্তু এখন যেন ভয়ে নুপুরের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে, অঝোর ধারায় ওর দুচোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল। লোকটা পাশে বসলো তারপর বলল ‘আহা ভয় পাচ্ছো কেন ? সব ঠিক হয়ে যাবে। কোনো ভয় নেয় তোমার, দেখ তোমারও ভাল লাগবে।’ নুপুরকে বিছানায় শোয়ালো একটা একটা করে নুপুরের পোশাক গুলোও নুপুরের মত অসহায় হয়ে মেঝের উপর পড়তে লাগল।

প্রায় অচেতন অবস্থায় বিছানার উপর পড়ে আছে নুপুর। বেশ কিছুক্ষণ পরে হাসি খালা আসলেন। এসে নুপুরকে দেখে তিনিও চমকে উঠলেন। ফাহাদ সাহেব হাসির মাকে বললেন আরে চমকাচ্ছো কেন? ব্যাপার না সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রথম তো একেবারে ইনটেক ছিল বুঝলে, আর তোমাকেও পুষিয়ে দিব চিন্তা করো না, এখন এক কাজ করো ওকে নিয়ে যাও। আর দুদিন পর আবার নিয়ে এসো, ওকে খুব ভাল লাগছে আমার এরকম এক নম্বর জিনিস তো পাওয়ায় যায় না। বেশ কিছুক্ষণ পর নুপুরের একটু হুশ হলো কিন্তু শরীরটা প্রচ- ব্যাথা, শরীরের উপর দিয়ে যেন একটা সাইক্লোন বয়ে গেছে ওর। হাসি খালা নুপুরকে গোসল করতে বললেন নুপুর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে হাসি খালার দিকে। এরপর আবারও গোসল করে সে।

হাসির মাথাটা প্রচন্ড ঘুরছে সেই সাথে ওর পৃথিবীটাও। একবার পড়েও যাচ্ছিল হাসি খালা ওকে ধরলো আর বললো, ‘মাইয়া মাইনষের এতো দুব্বল হলে চলেনা। শরীরের উপর দিয়ে পাহাড় গেলেও শক্ত থাকন লাগে।’ যাবার সময় নুপুরের হাতে এক হাজার টাকার পাঁচ খান নোট ধরিয়ে দেয় ফাহাদ সাহেব।আর বলে আবার দুদিন পর এসো আরো পাবে। নুপুর হাত বাড়িয়ে টাকা গুলো নেই। এরপর হাসির খালার হাত ধরে হাটতে থাকে নগরের আলো আঁধারির পথে।

এতদিন যে কিশোরী শরীরটাকে সে ঢেকে রেখেছিল অতি যতনে। কতজনের শত প্রলোভনেও যে শরীরটাকে কারও খাদ্য বানাতে চায়নি। সে শরীরটাকে আজ শহরের নিয়ন বাতির আড়ালে বিসর্জন দিয়ে আসল কেউ জানবেনা সে হারানো ব্যাথা কি।

সাগর নামে মগবাজার বস্তির এক দোকানদার নুপুরকে প্রতিদিন ভালবাসার কথা বলতো। ওকে বিয়ে করতে চাইতো নুপুরও মনে মনে ভীষণ ভাবে চাইতো তাকে কিন্তু কোনোদিন সে কথা বলেনি তাকে। বলা হয়নি বলতে পারেনি। নুপুর দেখলো ওর চারপাশে অসংখ্য প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। শহরের লাল নীল বাতিতে সেসব প্রজাপতিগুলোকে ভীষণ বিবর্ণ লাগছে..




কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.